মহাকাশে ‘দানব’ হয়ে উঠছে স্টারলিংক!

ফুয়াদ হাসান, টিবিএন ডেস্ক

জুলাই ৩০ ২০২৩, ১১:৪৪

স্টারলিংকের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। গ্রাফিক্স: নিউ ইয়র্ক টাইমস

স্টারলিংকের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। গ্রাফিক্স: নিউ ইয়র্ক টাইমস

  • 0

জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক এ. মিলি এবং ইউক্রেইনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি গত ১৭ মার্চ ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে আলোচনা করতে একটি কল করেন। সুরক্ষিত লাইনে দুই সামরিক নেতা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধক্ষেত্রের রিয়েল-টাইম মূল্যায়ন এবং রাশিয়ার সামরিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করেন।

তারা ইলন মাস্ক সম্পর্কেও কথা বলেছেন

আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানেন এমন তিন ব্যক্তি বলেছেন, জেনারেল জালুঝনি মিস্টার মাস্কের রকেট কোম্পানি- স্পেসএক্সের মাধ্যমে তৈরি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট প্রযুক্তি স্টারলিঙ্কের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। জেনারেল জালুঝনি বলেন, ইউক্রেইনের যুদ্ধক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত যোগাযোগগুলো স্টারলিঙ্কের ক্রমাগত ব্যবহারের উপর নির্ভর করছে। তিনি জানান তার দেশ অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা এবং পরিষেবার খরচ কীভাবে মেটানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে চায়।

জেনারেল জালুঝনি জানতে চেয়ছিলেন, বিস্তৃত ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং অস্পষ্ট রাজনীতি ঘিরে থাকা মিস্টার মাস্ক সম্পর্কে অ্যামেরিকার কাছে কোনো মূল্যায়ন আছে কি না, তবে এর কোনো উত্তর অ্যামেরিকান কর্মকর্তারা দেননি।

স্পেসএক্স, টেসলা এবং টুইটারের নেতৃত্ব দেয়া মিস্টার মাস্ক মহাকাশে সবচেয়ে প্রভাবশালী খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন, কারণ তিনি স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের উপর অবিচ্ছিন্ন ক্ষমতা সংহত করেছেন। সামান্য নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের মুখোমুখি হলেও তার অপ্রত্যাশিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক আচরণ বিশ্বজুড়ে সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতাদের ক্রমাগত উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ার কখনও কখনও অপ্রত্যাশিত উপায়ে তার কর্তৃত্ব পরিচালনা করেন।

মাস্ক ২০১৯ সাল থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে স্পেসএক্স রকেট মহাকাশে পাঠিয়েছেন যা প্রতিবার পৃথিবীর কক্ষপথে কয়েক ডজন সোফার সমান স্যাটেলাইট পৌঁছে দিয়েছে। স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর টার্মিনালগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত, ফলে গ্রহের প্রায় প্রতিটি কোণে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা সম্ভব। বর্তমানে ৪,৫০০টিরও বেশি স্টারলিংক স্যাটেলাইট আকাশে রয়েছে, যা সমস্ত সক্রিয় স্যাটেলাইটের ৫০ শতাংশেরও বেশি। আগামী বছরগুলোতে কক্ষপথে অন্তত ৪২,০০০ স্যাটেলাইট স্থাপনে মাস্কের পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার আগেই এগুলো রাতের আকাশের রঙ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে।

এছাড়া স্পেসএক্স, টেসলা এবং টুইটারের নেতৃত্বে থাকা মাস্ক স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে ক্রমাগত ক্ষমতা অর্জনের কারণে মহাকাশে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাক্তি হয়ে উঠেছেন। কম নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির মুখোমুখি হওয়ার কারণে তার অনিয়মিত এবং ব্যক্তিত্ব-চালিত চলাফেরা বিশ্বজুড়ে সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। প্রযুক্তি বিলিয়নিয়ার মাস্ক কখনও কখনও নিজের আওতার বাইরে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে তার কর্তৃত্ব ব্যবহার করেছেন।

একটি বৈশ্বিক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক

পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে ৪,৫০০টিরও বেশি স্টারলিংক স্যাটেলাইট। সম্প্রতি উৎক্ষেপিত স্যাটেলাইটগুলো কক্ষপথে তাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে যাদের রাতের আকাশে হঠাৎ দেখে তারার ট্রেন বলে ভুল হতে পারে।

স্টারলিংক প্রায়ই যুদ্ধক্ষেত্র, প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার একমাত্র উপায়। এটি ইউক্রেইনে ড্রোন হামলা এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও সমন্বয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। ইরান ও তুর্কিয়ের অ্যাক্টিভিস্টরা এই পরিষেবাটিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধক হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। অ্যামেরিকার ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট স্টারলিংকের এক বড় গ্রাহক। জাপান ও অন্যান্য সামরিক বাহিনী প্রযুক্তিটি পরীক্ষা করছে বলে জানা গেছে।

এর সঙ্গে স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের ওপর মাস্কের প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

উত্তেজনাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ৫২ বছর বয়সী মাস্কের আনুগত্য অস্পষ্ট। মাস্ক একজন প্রতিভাবান উদ্ভাবক হিসেবে প্রশংসিত হলেও তিনি একাই কোনো গ্রাহক বা দেশের জন্য স্টারলিংক ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একই সঙ্গে পরিষেবাটির সংগৃহীত সংবেদনশীল তথ্যকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা তার রয়েছে। এ ধরনের উদ্বেগ আরও বেড়েছে কারণ আপাতত স্টারলিংকের কোন বিকল্প নেই। কোনো সংস্থা বা সরকারের এখনও ক্ষমতা হয়নি মাস্কের মতো কিছু তৈরি করার।

ইতোমধ্যে ইউক্রেইন যুদ্ধে কিছু মাস্ক সম্পর্কে কিছু ভয় সঠিক হিসেবে দেখা গেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধের সময় মাস্ক একাধিকবার স্টারলিংকে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত করেছেন বলে। এক পর্যায়ে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশলকে প্রভাবিত করে ক্রিমিয়ার কাছে স্টারলিংক চালুর জন্য ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া তিনি গত বছর প্রকাশ্যে যুদ্ধের জন্য একটি ‘শান্তি পরিকল্পনা’ উত্থাপন করেছিলেন, যা রাশিয়ার স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল।

মাঝে মাঝে মাস্ক খোলাখুলিভাবে স্টারলিংকের সক্ষমতা তুলে ধরেছেন। তিনি এপ্রিলে টুইট করেছিলেন, ‘টেসলা, স্টারলিংক এবং টুইটার মিলিয়ে সম্ভবত আমার কাছে অন্য যে কারও চেয়ে বেশি রিয়েল-টাইম বৈশ্বিক অর্থনৈতিক তথ্য রয়েছে।’

সর্বোচ্চ সক্রিয় স্যাটেলাইট স্টারলিংকের

স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে প্রায় ৩০০ মাইল উপরে কাজ করে যা ‘লোয়ার-আর্থ অরবিট’ নামে পরিচিত। এটি প্রচলিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা যা ‘জিওসিঙ্ক্রোনাস কক্ষপথে’ বেশি উচ্চতায় কাজ করে, সেগুলোর চেয়ে ৬০ গুণ বেশি কাছাকাছি অবস্থান করে।

তবে মাস্ক এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। স্পেসএক্সও এ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

মাস্কের প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউক্রেইনের কর্মকর্তারা অন্যান্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সরবরাহকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। যদিও তারা স্টারলিংকের কাছের প্রতিদ্বন্দ্বীও নয় বলে স্বীকার করেছেন।

ইউক্রেইনের ডিজিটাল মিনিস্টার মাইখাইলো ফেডোরভ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘স্টারলিংক এখন আমাদের সমগ্র যোগাযোগ অবকাঠামোর শোনিত।’

ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্তত নয়টি দেশ গত ১৮ মাসে অ্যামেরিকান কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্টারলিংক নিয়ে আলোচনা করেছে এবং কেউ কেউ এই প্রযুক্তির ওপর মাস্কের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। গোয়েন্দা ও সাইবার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেন, মাস্কের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে খুব কম দেশই প্রকাশ্যে তাদের উদ্বেগের কথা জানায়।

অ্যামেরিকান কর্মকর্তারা স্টারলিংক সম্পর্কে প্রকাশ্যে খুব কমই বলেছেন, কারণ তারা মাস্কের সঙ্গে সম্পর্কিত অভ্যন্তরীণ এবং ভূ-রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখেন। মাস্ক প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমালোচনা করেন, তবে তার প্রযুক্তি অপরিহার্য।

ফেডারেল সরকার স্পেসএক্সের বৃহত্তম গ্রাহকদের মধ্যে একটি, নাসা মিশন এবং সামরিক নজরদারি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য তাদের রকেট ব্যবহার করে। পেন্টাগনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্টারলিংক ও ইউক্রেইনের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলোতে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছেন।

ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট স্টারলিংকের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, তবে তারা এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

অন্য সরকাররাও সতর্ক অবস্থানে আছে। তাইওয়ান ও অ্যামেরিকান কর্মকর্তারা জানিয়েছে, চায়নার সঙ্গে মাস্কের ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে আংশিকভাবে এই সেবাটি ব্যবহারে অনিচ্ছুক তাইওয়ান। এর সঙ্গে চায়নার আগ্রাসনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এমন ইন্টারনেট অবকাঠামো থাকা ভীতিকর হবে তাইওয়ানের জন্য।

এদিকে স্টারলিংক নিয়ে নিজেরাই উদ্বেগে রয়েছে চায়না। গত বছর মাস্ক বলেছিলেন, বেইজিং আশ্বাস চেয়েছিল তিনি চায়নার অভ্যন্তরে স্টারলিংক চালু করবেন না। চায়নায় ইন্টারনেট রাষ্ট্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত এবং সেন্সর করা হয়। চায়না ২০২০ সালে তার নিজস্ব ১৩,০০০ ইন্টারনেট স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে।

স্টারলিংক এবং মাস্ক সম্পর্কে সন্দেহের কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও বেসামরিক ও সামরিক ব্যবহারের জন্য একটি স্যাটেলাইটের বহর নির্মাণের জন্য গত বছর ২.৪ বিলিয়ন ইউরো বা ২.৬ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে।

সিলভারাডো পলিসি অ্যাকসেলারেটর থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি আলপেরোভিচ বলেন, ‘এটি কেবল একটি সংস্থা নয়, এটি একটি ব্যক্তি। আপনি তার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ।’

আকাশস্পর্শী

ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার মার্টিন সুইটিং স্যাটেলাইট ডিজাইন এবং উৎপাদনকারী সংস্থা ‘সারে স্যাটেলাইট টেকনোলজি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাকে তার একজন ব্যবসায়িক সহযোগী মঙ্গলে গ্রিনহাউস স্থাপন করতে চান এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে ২০০১ সালে দেখা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। পরে দেখা যায় তিনিই মাস্ক।

সুইটিং এবং মাস্ক কলোরাডোতে একটি মহাকাশ সম্মেলনের পর একসঙ্গে সকালের নাস্তা করেছিলেন। যেখানে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাস্ক নাসার সমালোচনা করেন এবং একটি ব্যক্তিগত মহাকাশ বহর তৈরির বিষয়ে কথা বলেছিলেন।

সুইটিং বলেছেন, ‘তিনি খুব মনোযোগী ছিলেন।’

সুইটিং-এর সংস্থা পরে মাস্কের কাছ থেকে বিনিয়োগ পেয়েছিল এবং ২০০৯ সালে এয়ারবাসের কাছে বিক্রি হওয়ার আগে তাকে পরিচালনা পর্ষদে রেখেছিল।

মাস্ক গবেষণার একটি উদীয়মান ক্ষেত্র সম্পর্কেও আগ্রহী ছিলেন, যেখানে ছোট স্যাটেলাইটগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েকশ মাইল উপরে আকাশে স্থাপন করা হয়। এটি ‘লোয়ার-আর্থ অরবিট’ নামে পরিচিত।

তাদের একসঙ্গে কাজ স্টারলিংকের ধারণায় সহায়তা করবে এমন প্রযুক্তিতে মাস্কের আগ্রহের প্রথম উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৬০ এর দশকের স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত বড় হয়। এগুলো প্রায়ই স্কুল বাসের আকারের হয় এবং মহাকাশে উচ্চস্থানে অবস্থিত। এটি ‘জিওসিঙ্ক্রোনাস কক্ষপথ’ নামে পরিচিত এবং এগুলোর যোগাযোগ সক্ষমতা সীমিত। ছোট স্যাটেলাইটগুলো কম উচ্চতার কক্ষপথে অবস্থান করতে পারে, ফলে এরা পৃথিবীর টার্মিনালগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে এবং দূরবর্তী স্থানে উচ্চ গতির ইন্টারনেট পরিষেবার জোগান দিতে পারে।

এজন্য অনেক ছোট ছোট স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হয়। কারণ একটি স্যাটেলাইট যখন স্থলভাগে স্টারলিংক টার্মিনালের দূরে চলে যায়, তখন এটির ব্যবহারকারীদের কাছে একক, নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ বজায় রাখার জন্য পিছনে অন্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগ দেয়।

স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলো প্রচলিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবার চেয়ে অনেক কম উচ্চতায় কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। ফলে প্রতিটি স্টারলিংক স্যাটেলাইট ছোট অঞ্চল কভার করে এবং ভূমির টার্মিনালগুলোকে ক্রমাগত নিকটতম পাসিং স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজন হয়।

মাস্ক ২০১৯ সালে তার প্রথম স্টারলিংক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেন। সে সময় স্যাটেলাইট ইন্টারনেটকে বোকার কাজ হিসেবে দেখা হতো। ১৯৯০ থেকে ২০০০ এর দশকে অন্য সংস্থাগুলো মহাকাশে পৌঁছানোর ব্যয় এবং প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে লোয়ার-আর্থ অরবিটে যোগাযোগ স্যাটেলাইটগুলো পাঠাতো না।

তবে মাস্কের একটি সুবিধা ছিল। স্পেসএক্সের রকেটগুলো মহাকাশ ভ্রমণের পরে পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং এগুলো আংশিকভাবে ফের ব্যবহারযোগ্য। এটি কার্যকরভাবে তাকে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ দেয়, যা ক্রমাগত মহাকাশে স্যাটেলাইট সরবরাহ করতে পারে। কখনও কখনও একবারে কয়েক ডজন স্যাটেলাইট পাঠানো সম্ভব হয়।

এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে স্টারলিংক স্যাটেলাইট বোঝাই একটি স্পেসএক্স রকেট ক্যালিফোর্নিয়া বা ফ্লোরিডার সাইট থেকে উড্ডয়ন করে। প্রতিটি স্যাটেলাইট প্রায় সাড়ে তিন বছর কর্মক্ষমতার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। কক্ষপথে এত স্যাটেলাইট রয়েছে যে মানুষ প্রায়ই এগুলোকে তারা খসা মনে করে ভুল করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নথিভুক্ত করেছেন ডিভাইসগুলো কীভাবে গবেষণা টেলিস্কোপের কাজে হস্তক্ষেপ করছে এবং এদের সংঘর্ষের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।

ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্যাট্রিক সিটজার বলেন, ‘রাতের আকাশ সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল প্রাকৃতিক দৃশ্যের অন্যতম, তবে মানুষ একে চিরতরে পরিবর্তন করতে চলেছে।’

স্টারলিংক সাধারণত প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ মেগাবিট ইন্টারনেট ডাউনলোড গতি সরবরাহ করে, যা সাধারণ ল্যান্ডলাইন পরিষেবার সঙ্গে তুলনীয়। স্পেসএক্স সাধারণত মহাকাশ থেকে সংযোগ গ্রহণের প্রতিটি টার্মিনালের জন্য গ্রাহকদেরকে প্রায় ৬০০ ডলার চার্জ করে। পাশাপাশি প্রায় ৭৫ ডলারের মাসিক ফি এবং ব্যবসা ও সরকারদের জন্য ব্যয় আরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতিটি স্টারলিংক টার্মিনালের অবস্থান ও উচ্চতা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটি জানে।

আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২১ সালে কয়েকটি দেশে আত্মপ্রকাশ করা এই পরিষেবাটি এখন অ্যামেরিকা, জাপান, ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ এবং লাতিন অ্যামেরিকার কিছু অংশসহ ৫০টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চলে পাওয়া যাচ্ছে। স্টারলিংকের ওয়েবসাইট অনুযায়ী আফ্রিকা ইন্টারনেট সুবিধায় বাকি বিশ্বের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। স্টারলিংক নাইজেরিয়া, মোজাম্বিক এবং রুয়ান্ডায় পাওয়া যাচ্ছে এবং ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ আরও এক ডজনেরও বেশি দেশে এ সেবা পাওয়া যাবে।

জো রোগান পডকাস্টে ২০২০ সালে মাস্ক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘পৃথিবীর সর্বত্র উচ্চ ব্যান্ডউইথ, কম লেটেন্সি ইন্টারনেট থাকবে।’

সামরিক বাহিনী, টেলিকম সংস্থা, এয়ারলাইন্স, ক্রুজ লাইন এবং সামুদ্রিক শিপাররা স্টারলিংক-এর সেবা নিতে ইতোমধ্যে ভিড় করেছে। স্টারলিংক জানিয়েছে, তাদের ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহক রয়েছে।

স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভুগছে, যদিও প্রতিযোগিতা বাড়ছে। ওয়ানওয়েব নামের একটি বৃটিশ সংস্থা আর্থিক সমস্যায় এতটাই জর্জরিত ছিল যে একে বৃটিশ সরকার থেকে জামিন নিতে হয়েছিল এবং একদল বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করতে হয়েছিল। রকেট কোম্পানি ব্লু অরিজিনের মালিক জেফ বেজোসের প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রজেক্ট কুইপারের পরিকল্পনা করেছে, তবে এটি এখনও মহাকাশে কোনো স্যাটেলাইট পাঠায়নি।

যুদ্ধক্ষেত্রে স্টারলিংক

ইউক্রেইন যুদ্ধের চেয়ে স্টারলিংকের শক্তি এবং মাস্কের প্রভাব আর কোনো ঘটনাতেই প্রদর্শিত হয়নি।

ইউক্রেইনে ৪২,০০০ এরও বেশি স্টারলিংক টার্মিনাল এখন সামরিক, হাসপাতাল, ব্যবসা এবং সহায়তা সংস্থার মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। গত বছর রাশিয়ার বোমা হামলার সময় ইউক্রেইনের সরকারি সংস্থাগুলো অনলাইনে থাকার জন্য স্টারলিংকের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউক্রেইনের এক ডেপুটি কমান্ডার বলেন, ‘স্টারলিংক ছাড়া আমরা বিমান উড়াতে পারি না, যোগাযোগ করতে পারি না।’

রাশিয়া ইউক্রেইনে আক্রমণের পর ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত উচ্চগতির যোগাযোগ সংস্থা ভিয়াস্যাট দ্বারা পরিচালিত একটি স্যাটেলাইট সিস্টেমকে ধ্বংস করে দেয়। তারপর স্টারলিংক ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে প্রবেশ করে। সৈন্য এবং কমান্ডাররা অফলাইনে চলে যাওয়ার পরপর ডিজিটাল মিনিস্টার ফেডোরভ মাস্কের কাছে সাহায্যের জন্য একটি আবেদন করেছিলেন।

মাস্ক কয়েক ঘন্টার মধ্যে ফেডোরভের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, স্টারলিংক ইউক্রেইনে সক্রিয় হয়েছে। এর কয়েক দিন পরে স্টারলিংক টার্মিনাল পাঠানো হয়েছিল।

বন-জঙ্গল, যুদ্ধক্ষেত্র, গ্রাম এবং সামরিক যানবাহনের ছাদে লাগানো এই প্রযুক্তি ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীকে রাশিয়ান বাহিনীর চেয়ে বড় সুবিধা দিয়েছে। এটি আর্টিলারি দল, কমান্ডার এবং পাইলটদের অনলাইনে চ্যাট করার সময় একযোগে ড্রোন ফুটেজ দেখতে সক্ষম করেছে। সৈন্যরা জানিয়েছে, লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে আঘাত হানার সময় প্রায় ২০ মিনিট থেকে কমিয়ে প্রায় এক মিনিট হয়েছে এ প্রযুক্তিতে।

ফেডোরভ বলেন, ‘স্টারলিংক যে বিপুলসংখ্যক জীবন বাঁচাতে সহায়তা করেছে তার পরিমাণ হাজার হাজার। এটি আমাদের সাফল্যের অন্যতম মৌলিক উপাদান।’

এর সঙ্গে ইউক্রেইন এবং পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মধ্যে এই প্রযুক্তির উপর মাস্কের দখল নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। গত শরৎকালে যখন তিনি যুদ্ধ সম্পর্কে বারবার মন্তব্য করেছিলেন তখন ইউক্রেইনে স্টারলিংকের সেবার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে প্রশ্ন উঠছিল।

কলোর অ্যাসপেনে সেপ্টেম্বরে বিশ্ব ও ব্যবসায়িক বিষয়সম্পর্কিত একটি ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে তখনকান হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এবং অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। মাস্ক সেখানে ইউক্রেইনের জন্য একটি শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিলেন, যার মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেইনের ভূখণ্ড সংযুক্ত করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রস্তাবটি অনেক অংশগ্রহণকারীকে ক্ষুব্ধ করেছিল।

সে সময় ইউক্রেইনে স্টারলিংকের পরিষেবার জন্য কে অর্থ দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। স্পেসএক্স প্রাথমিকভাবে কিছু ব্যয় বহন করেছিল, এর সঙ্গে অ্যামেরিকা এবং অন্যান্য মিত্ররাও তহবিল সরবরাহ করেছিল।

একই মাসে স্পেসএক্স অ্যামেরিকান ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টকে জানায়, তারা এ ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে পারবে না এবং পেন্টাগনকে তহবিলের জন্য বলেছিল। সিএনএন-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী স্পেসএক্সের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ১২ মাসে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।

বাইডেন প্রশাসন পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তা কলিন এইচ কাহলকে মধ্যস্থতার নির্দেশ দিয়েছে। কাহল মাস্ককে গত ৭ অক্টোবর ফোন করে বলেন, ইউক্রেইন শুধু নিজেদের রক্ষার জন্যই স্টারলিংক ব্যবহার করবে না বরং রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করবে। এটি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কাহল মাস্ককে বলেছিলেন স্টারলিংক বন্ধ করা হলে ইউক্রেইনের আরও লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

মাস্ক তবু ইউক্রেইনের কিছু স্টারলিংক টার্মিনালের অ্যাক্সেস বন্ধ করে দিয়েছেন। গত বছরের শেষের দিকে একটি বৃটিশ সরবরাহকারীর মাধ্যমে কেনা প্রায় ১,৩০০ স্টারলিংক টার্মিনাল কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল, কারণ ইউক্রেইন সরকার প্রতিটির জন্য মাসিক ২,৫০০ ডলার ফি দিতে পারেনি।

স্টারলিংক অ্যাক্সেসও যুদ্ধের গতিবিধির উপর নির্ভর করে ওঠানামা করেছিল কারণ রাশিয়া অঞ্চলটি জিতেছিল এবং ইউক্রেইন এটি ফিরে পেতে লড়াই করছিল। যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন স্থানান্তরিত হওয়ার পরপর মাস্ক সামনের লাইনগুলোতে স্টারলিংক সেবা সীমাবদ্ধ করার জন্য জিওফেন্সিং নামে একটি প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছিলেন। স্পেসএক্স জিওফেন্সিং সীমা প্রয়োগ করতে তার পরিষেবার সংগৃহীত টার্মিনালের অবস্থানের ডেটা ব্যবহার করে।

এতে ইউক্রেইনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা যখন রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে খেরসনের মতো শহরগুলি ফের দখলের চেষ্টা করেছিল, তখন তাদের যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের প্রয়োজন ছিল। ফেডোরভ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মাস্ক ও স্পেসএক্স কর্মীদের বার্তা পাঠিয়ে সেনাবাহিনী যে সব এলাকায় অগ্রসর হচ্ছে সেখানে পরিষেবা পুনরুদ্ধার করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

ফেডোরভ বলেন, স্পেসএক্স ‘খুব দ্রুত’ সাড়া দিয়েছে।

মাস্কের কিছু রেড লাইন ছিল, যা তিনি অতিক্রম করবেন না জানিয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণ সাগরে অবস্থানরত রাশিয়ান জাহাজ লক্ষ্য করে সামরিক ড্রোন পাঠানোর জন্য রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত উপদ্বীপ ক্রিমিয়ায় স্টারলিংককে এক্সেস দেয়ার জন্য গত বছর ইউক্রেইনের অনুরোধ মাস্ক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মাস্ক পরে বলেছিলেন স্টারলিংক দূরপাল্লার ড্রোন হামলার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।

অন্যান্য অ্যামেরিকান কর্মকর্তারাও বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। গত জুনে ডিফেন্স সেক্রেটারি লয়েড অস্টিন ৪০০ থেকে ৫০০টি নতুন স্টারলিংক টার্মিনাল ও সেবা কেনার জন্য পেন্টাগনের একটি চুক্তি অনুমোদন করেন। চুক্তির সঙ্গে যুক্ত দুই ব্যক্তি বলেন, এই চুক্তির ফলে ইউক্রেইনের অভ্যন্তরে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সিগন্যাল কোথায় কাজ করবে, তা পেন্টাগনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটি ইউক্রেইনকে বাধার ভয় ছাড়াই সংবেদনশীল অভিযান পরিচালনা করার জন্য ডেডিকেটেড টার্মিনাল এবং পরিষেবা সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিল।

প্রথাগত প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের বিপরীতে স্টারলিংক একটি বাণিজ্যিক পণ্য। ব্লু-অরিজিনে কর্মরত ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের সাবেক কর্মকর্তা গ্রেগরি সি অ্যালেন বলেন, এর ফলে মাস্ক এমনভাবে কাজ করতে পারবেন, যা কখনও কখনও অ্যামেরিকার স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন স্পেসএক্স বলেছিল, তারা ইউক্রেইনে স্টারলিংককে অর্থায়ন অব্যাহত রাখতে পারবে না।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে কর্মরত অ্যালেন বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই আমরা দেখেছি একটি কোম্পানি এবং এ ধরনের একজন ব্যক্তি যুদ্ধের মাঝখানে অ্যামেরিকার পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলছে।’

মাস্কের এমন আচরণ ইউক্রেইনের কর্মকর্তাদের বিভক্ত করেছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মাইখাইলো পোদোলিয়াক গত ফেব্রুয়ারিতে টুইটারে বলেন, স্পেসএক্সকে একটি পক্ষ বেছে নিতে হবে।

তবে ফেডোরভ বলেছেন, মাস্কের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন করা অন্যায্য। ইউক্রেইন যখন ভারী বোমাবর্ষণের মুখে ছিল এবং নভেম্বরে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মুখোমুখি হয়েছিল, তখন মাস্ক প্রায় ১০,০০০ স্টারলিংক টার্মিনাল সরবরাহকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছিলেন।

ফেডোরভ বলেন, ‘স্পেসএক্স এবং ইলন মাস্ক তাদের কাজের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে তারা আসলে কার পক্ষে রয়েছেন।’

তাইওয়ান থেকে ইউরোপ

তাইওয়ানের প্রধান দ্বীপ এবং মাতসু দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে চলাচলকারী সমুদ্রের তলদেশের দুটি ইন্টারনেট ক্যাবল গত ফেব্রুয়ারিতে চায়না শিপিং জাহাজের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনার ফলে মাতসু জুড়ে অনলাইন সংযোগ ব্যাহত হয়েছিল। তাইওয়ানের যোগাযোগ অবকাঠামো দুর্বল ছিল বলে উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছিল।

তাইওয়ানকে চায়না তার নিজস্ব অঞ্চল হিসেবে দাবি করেছে সেখানে স্টারলিংক আনার জন্য একটি আদর্শ জায়গা বলে মনে হবে। তবে তাইওয়ান এতে অনিচ্ছুক, কারণ সরকার মাস্কের সঙ্গে কাজ করার ঝুঁকি ও স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের শক্তিকে মূল্যায়ন করে সংযোগ নিয়ঙার বিষয়টি বিবেচনা করতে চায়।

তাইওয়ানের সাবেক আইনপ্রণেতা জেসন সু বলেন, তাইওয়ানের কর্মকর্তারা স্টারলিংক নিয়ে স্পেসএক্সের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে আলোচনা আংশিকভাবে ধীর হয়ে গেছে, কারণ মাস্ককে নিয়ে ‘প্রচণ্ড উদ্বেগ’ রয়েছে। মাস্কের আর্থিক স্বার্থ চায়নার সঙ্গে জড়িত। টেসলার নতুন গাড়ির প্রায় ৫০ শতাংশ সাংহাইতে তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাইওয়ান বিশ্বাস করে না- বেইজিং পরিষেবাটি বন্ধের চাপ প্রয়োগ করলে স্টারলিংক সংযোগ সরবরাহ করবে।

তাইপের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সু বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে আমরা যদি স্টারলিংক থেকে ডিভাইস অর্ডার করি তবে আমরা এক ধরনের ফাঁদে পড়ব। চায়নায় ইলনের বিশাল বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে।’

অ্যামেরিকান কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দল গত এপ্রিলে তাইওয়ান সফরের সময় টেক্সাসের প্রতিনিধি ও হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককাউল মধ্যাহ্নভোজে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনকে স্টারলিংক ব্যবহারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। কমিটির কর্মকর্তারা জানান, চায়নার সঙ্গে মাস্কের যোগাযোগের কারণে তাইওয়ানের জন্য এই সেবা কার্যকর বিকল্প নয় বলে কংগ্রেসের সহযোগীরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

তাইওয়ানের ডিজিটাল মিনিস্টার অড্রে তাং বলেছেন, দেশটি জুনে ওয়ানওয়েবের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে এবং কোনো স্যাটেলাইট সরবরাহকারীর সঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি।

মাস্কের প্রভাব নিয়ে অন্যত্র বিতর্ক হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্টারলিংকের আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ২৭টি দেশ ২০২৭ সালের মধ্যে উৎক্ষেপণের জন্য একটি ‘সার্বভৌম’ স্যাটেলাইট ব্যবস্থার জন্য গত বছর ২.৪ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করতে বাধ্য হয়েছে।

প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানে থাকা ইউরোপীয় কমিশনার থিয়েরি ব্রেটন বলেন, ‘মহাকাশ একটি অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে পারে না।’

সরকারের চাহিদা মেটাতে স্পেসএক্স গত বছর স্টারলিংক সম্পর্কিত একটি সেবা স্টারশিল্ড চালু করে, যা গোপনীয় তথ্য পরিচালনা এবং সংবেদনশীল ডেটা প্রক্রিয়াকরণের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা সরবরাহ করে।

স্টারলিংক কর্তৃত্ববাদী সরকারদের সমালোচনার মুখোমুখিও হয়েছে।

ইরানে গত বছর সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরুর পর মাস্ক সেখানে স্টারলিংক চালু করেন, যাতে অ্যাক্টিভিস্টরা অনলাইনে থাকতে পারেন। ইরান সরকার স্পেসএক্সকে তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছে।

চায়না এ বছর জাতিসংঘের একটি প্যানেলের কাছে অভিযোগ করেছিল, স্পেসএক্স এত বেশি স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করছে যে, এখন এটি অন্যদের মহাকাশে প্রবেশে বাধা দেবে। তুর্কিয়েতে ফেব্রুয়ারিতে একটি বড় ভূমিকম্পের পরে স্টারলিংক অ্যাক্সেস দেয়ার জন্য মাস্কের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল তুর্কিয়ে। সুশীল সমাজের প্রতিকূল সংবাদগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া রোধের প্রচেষ্টা হিসেবে একে দেখেছিল সবাই।

ডিজিটাল অধিকার সংস্থা অ্যাকসেস নাও-এর জন্য তুর্কিয়ের নীতি বিশ্লেষক চেরিফ এল কাধি বলেন, ‘সরকার ভয় পেয়েছিল। কারণ স্টারলিংক তার নিয়ন্ত্রণে নেই এবং এটি একটি হুমকি ডেকে আনতে পারে।’

মহাকাশে মাস্কের আধিপত্যের সামনে খুব শিগগিরই কারও সমান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গত মে মাসে অ্যামাজন তাদের প্রথম দুটি স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপনের প্রস্তুতি নিলেও রকেট পরীক্ষায় সমস্যা ধরা পড়ার পর উৎক্ষেপণ স্থগিত রাখা হয়।

এরপর থেকে মাস্ক আরও অন্তত ৫৯৫টি স্টারলিংক স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছেন।

[নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত]