যে নারী পাইলটের ফ্লাইট রেকর্ড গোপন রাখা হয়েছিল

টিবিএন ডেস্ক

জুন ৮ ২০২৪, ১০:৪১

১৯৮৪ সালে বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের প্রথম নারী পাইলট লিন রিপেলমেয়ার। ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৪ সালে বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের প্রথম নারী পাইলট লিন রিপেলমেয়ার। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট থেকে পাইলট হয়ে ওঠা লিন রিপেলমেয়ার। যার আকাশে ওড়ার গল্পের শুরুটা হয়েছিল এক অসম্ভব জায়গা থেকে। অ্যামেরিকার প্রথম নারী চালিত বাণিজ্যিক ফ্লাইট ছিল দুইজন নারী পাইলটসহ রিপেলমায়ারকে নিয়ে। তবে এই ফ্লাইটের ইতিহাস গোপন রাখা হয়েছে বহুদিন।

ইলিনয়ে জন্ম নেয়া রিপেলমায়ারের বেড়ে ওঠা একটি ফার্মে । ১৯৫০ এর দশকের সেই সময়ে বিমান চালনার জন্য কোন নারী পাইলট ছিলেন না। মাথার ওপর দিয়ে রোজ বিমান উড়ে যেতে দেখে রিপেলমায়ারের মনে ভাবনা আসে বড় হয়ে পাইলট হওয়ার। সেই থেকে এভিয়েশনের প্রতি আগ্রহ জন্মে তার।

সেই কল্পনা বাস্তবায়িত হতে থাকে যখন তিনি বড় হয়ে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট হন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন জনপ্রিয় বড় বিমান সংস্থা টিডাব্লুউএ-তে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর এভিয়েশনের সঙ্গে ক্যারিয়ার শুরু হয় তার। সংস্থাটির ‘কুইন অফ দ্য স্কাইস’ খ্যাত বোয়িং-সেভেন ফোর সেভেনে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি।

বিমান কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন রিপেলমায়ার। রিপেলমায়ার বলেন, ‘আমি ককপিটে কী চলছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করতাম, তাদের কাজ ও বিমান সম্পর্কে জানতে চাইতাম। এই প্রসঙ্গটি উঠলে আলোচনা খুব জমত এবং আমি আলোচনাগুলো অনেক উপভোগ করতাম।’

সেই সময় বড় বিমানগুলোতে দুইজন পাইলট এবং একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার থাকত। পাইলটদের পেছনেই বসতেন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। যার জন্য তার সঙ্গে পাইলটদের যোগাযোগ করা সহজ হতো। রিপেলমায়ার তাদের কাছে সুইচ, হাইড্রোলিক্স ও ইঞ্জিন সম্পর্কে জানতে ও শিখতে বেশি বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন।

রিপেলমায়ারের বিমান চালনা নিয়ে জানার আগ্রহ বাড়তেই থাকে। তিনি ভারমন্টে একটি ছোট বিমানে ট্রেনিং নিতে শুরু করেন।

১৯৭৫ সালে তিনি জানতে পারেন অ্যামেরিকায় প্রথম দুইজন নারী পাইলট হিসেবে বনি তিবুরজিকে অ্যামেরিকান এয়ারলাইন্স ও এমিলি ওয়ার্নারকে ফ্রন্টিয়ার এয়ারলাইনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

সেখান থেকে উৎসাহিত হয়ে রিপেলমায়ার মায়ামিতে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পাইলট ট্রেনিং শুরু করেন। পরে ১৯৭৬ সালে তিনি তার প্রথম বাণিজ্যিক বিমান চালনার লাইসেন্স পান।

এর এক বছরের মাথায় এয়ার ইলিনয়ে একটি টুইন ওটারে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে চাকরি হয় রিপেলমায়ারের।

বিমান সংস্থাটির ক্যাপ্টেন পদে ইতোমধ্যে একজন নারী পাইলট আগে থেকেই নিযুক্ত ছিলেন। রিপেলমেয়ারকে নিয়োগ দেয়ার পরে সংস্থাটির মালিক তাকে বলেছিলেন, দুইজন নারী পাইলট কখনোই একসঙ্গে উড়তে পারবেন না।

এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি বিমান চালানোর সময় কোন ভুল হয় তবে আমাদের সেখানে একজন পুরুষ রাখতে হবে, তাই না? আর আমরাও আমাদের যাত্রীদের ভয় দেখাতে চাই না। ঠিক কিনা?’

রিপেলমেয়ার বলেন, ‘তিনি মালিক ছিলেন বলেই তিনি যা খুশি নিয়ম তৈরি করতে পারতেন এবং সেই সময়ে এর বিরুদ্ধে কোন আইন বা বিধিবিধান ছিল না। তাই আমরা এটি মেনে নিয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘একদিন ক্যাপ্টেন এমিলি উপস্থিত থাকলেও ফার্স্ট অফিসার অসুস্থ হওয়ার কারণে উপস্থিত ছিলেন না। আমি ছাড়া আর কেউ সেদিন সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। বিমান সংস্থার মালিককে এটা জানাতে ফোন করতেই আমি ফোনে শুনতে পাই যে তিনি চিৎকার করে বলেছেন, আমি ফ্লাইটটি নিতে পারি তবে এটা নিয়ে কোন ঘোষণা দেয়া যাবে না। কাউকেই জানানো যাবে না যে দুইজন নারী পাইলট বিমান চালাবেন। তাই আমাদেরকে সেদিন ককপিটের দরজা বন্ধ রাখতে হয়েছিল।’

এতে ১৯৭৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুইজন নারী পাইলটসহ অ্যামেরিকার প্রথম ফ্লাইট আকাশে ওড়ে। তবে এটি গোপন রাখা হয়। আর যেহেতু কোন দুর্ঘটনা হয়নি সেজন্য এরপর থেকে আর এই দুই নারী পাইলটকে ইচ্ছাকৃতভাবে আলাদা রাখা হয়নি। রিপেলমায়ার জানিয়েছেন, এরপর অনেকবার তারা একসঙ্গে উড়েছেন।

রিপেলমেয়ার ও ক্যাপ্টেন এমিলি জোন্স এয়ার ইলিনয়ের সঙ্গে একটি ফ্লাইটের আগে।


শুরুর দিকে পাইলট হওয়ার কারণে তিনি যে বেতন পেতেন তা বাসা ভাড়া দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। খরচ চালানোর জন্য তখনও ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন রিপেলমায়ার।

পর্যাপ্ত ফ্লাইট অভিজ্ঞতা থাকায় বড় বিমান সংস্থাগুলোতে চাকরির চেষ্টা করেন তিনি। এর মধ্যে একটি ছিল বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ওজার্ক এয়ার লাইনস। এই সংস্থাটি সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়া শেষে রিপেলমায়ারকে প্রত্যাখ্যান করে তার উচ্চতার কারণে।

এরপরে তিনি টিডব্লিউএতে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পান এবং বোয়িং সেভেন টু সেভেনে ওড়েন। বিমানটিতে আরও দুজন নারী পাইলট ছিলেন এবং তাদের মধ্যে ভাল একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ট্রান্স ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইন্স (টিডাব্লুএ) ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।


রিপেলমায়ার বলেন, ‘আপনি প্রবেশন চলার সময় ছুটি নিতে পারবেন না। যে কোন এয়ারলাইনেই প্রথম বছর দারিদ্রতায় কাটে।’

সিবোর্ড ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইন্স নামে একটি কার্গোতেও ক্যারিয়ারে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। ওই সময় বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের ফার্স্ট অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি এবং ট্রান্সআটলান্টিক রুটে জেএফকে থেকে উড়ে যাম।

রিপেলমায়ার বলেন, বেশিরভাগ এয়ারলাইন্সে তিনি ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে শুরু করেন। সিবোর্ডে পেশাদার ইঞ্জিনিয়ার থাকলেও তাদের পাইলট লাইসেন্স ছিল না। যে কারণে পাইলট হিসেবে সরাসরি নিয়োগ পান রিপেলমায়ার এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফার্স্ট অফিসারের পদমর্যাদা লাভ করেন।

১৯৮০ সালে রিপেলমেয়ার সেভেন ফোর সেভেন চালানো প্রথম নারী পাইলট হন।

পিপল এক্সপ্রেসে কাজ করার সময়, রিপেলমেয়ার ট্রান্সওশানিক বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের প্রথম নারী পাইলট হন।


তিনি বলেন, ‘আমি ভাবিনি যে একজন নারী কখনও এটা করতে পারেন। কারণ আমি যে পুরুষ পাইলটদের সঙ্গে কাজ করেছি তারা আমাকে বলেছিলেন যে এটি মানসিক এবং শারীরিকভাবে খুব কঠিন। চার ইঞ্জিনের বিমানে যদি একদিকের দুটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় তবে বিমানটি সোজা রাখার জন্য রাডারটি নীচে ঠেলে দেয়ার শক্তি কোনও নারীর থাকবে না বলে তারা আমাকে এক প্রকার নিশ্চিত করেন।’

১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পিপিল এক্সপ্রেস নামে একটি বিমান সংস্থায় ফার্স্ট অফিসার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন রিপেলমায়ার। শুরুতে নিয়োগ পাওয়ার কারণে ক্যাপ্টেন হতে এক বছরের কম সময় লাগে তার। বিশ্বের প্রথম নারী এয়ারলাইন ক্যাপ্টেনদের একজন হন রিপেলমেয়ার।

পরে ১৯৮৪ সালে পিপল এক্সপ্রেস বোয়িং সেভেন ফোর সেভেন উড়তে শুরু এবং রিপেলমেয়ার নেওয়ার্ক থেকে লন্ডন গ্যাটউইক পর্যন্ত একটি ট্রান্সওশানিক জাম্বো ফ্লাইটের প্রথম নারী ক্যাপ্টেন হন।

পাইলট হিসেবে রিপেলমেয়ার তার শেষ ফ্লাইটটি পরিচালনা করেন ২০১৩ সালে। ওই সময় ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বোয়িং সেভেন এইট সেভেন ওড়ান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম ফোর সেভেন ফোর ফ্লাইটটি লন্ডনে ছিল এবং তারপরে আমার শেষ ফ্লাইট এইট সেভেনও লন্ডনে ছিল। এটি একটি নিখুঁত ফ্লাইট ছিল। দলটি ছিল অসাধারণ।’

একটি সেভেন ফোর সেভেনের ককপিটে লিন রিপেলমেয়ারের আরও একটি সাম্প্রতিক ছবি।


রিপেলমেয়ার ‘লাইফ টেকস উইংস’ এবং ‘লাইফ টেকস ফ্লাইট’ শিরোনামে দুটি স্মৃতিকথা লিখেছেন। যেখানে সেভেন ফোর সেভেন এবং সেভেন এইট সেভেনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেন।

তিনি মনে করেন যে বিমানচালনায় নারীদের ক্যারিয়ারের জন্য এখন অনেক উন্নয়ন হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এখন যেসব নারীরা বিমানের পাইলট হতে চান তাদের সেই সুযোগ রয়েছে। এভিয়েশন স্কুল এবং এয়ারলাইনস পুরুষদের মতোই নারী আবেদনকারীদের গ্রহণ করছে। নারীর প্রতি আর কোনো বৈষম্য দেখছি না।’