চায়নার এই নতুন এআই মডেলটি বিশেষ করে এর কম খরচে উচ্চ কার্যক্ষমতা অর্জনের সক্ষমতার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিপসিকের অভাবনীয় সাফল্য বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি শিল্পের কাঠামো পাল্টে দিতে পারে। তবে এর উত্থানকে পশ্চিমা দেশগুলো সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে।

ডিপসিক একটি ওপেন-সোর্স এআই চ্যাটবট যা অ্যামেরিকার চ্যাটজিপিটির মতোই ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কোড লিখতে পারে, গাণিতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে এবং সাধারণ কথোপকথন চালাতে পারে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে লিয়াং ওয়েনফেং নামের এক প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এআই প্ল্যাটফর্মগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।

ডিপসিকের শক্তিশালী মডেল ‘ডিপসিক আর ওয়ান’ চালু হওয়ার পর থেকে এটি প্রযুক্তি জগতে আলোড়ন তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মডেল ওপেনএআই-এর জিপিটি-ফোর এর সঙ্গে তুলনীয়, কিন্তু খরচ মাত্র ছয় মিলিয়ন ডলার, যেখানে জিপিটি-ফোর তৈরি করতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে।

কম খরচে উন্নত এআই তৈরি করায় ডিপসিক বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এটি গাণিতিক সমস্যা সমাধানে এবং প্রোগ্রামিংয়ে অত্যন্ত দক্ষ যা একে অন্যান্য মডেলের তুলনায় স্বতন্ত্র করে তুলেছে।

ডিপসিকের অভাবনীয় সাফল্যের পরপরই এটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিশেষ করে অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সাউথ কোরিয়া, ইতালি, তাইওয়ানসহ বেশ কয়েকটি দেশ সরকারি কর্মীদের জন্য ডিপসিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কংগ্রেস শিগগিরই একটি বিল পেশ করতে যাচ্ছে যেখানে সব সরকারি ডিভাইসে ডিপসিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব আনবে। ইতোমধ্যে নাসা ও নৌবাহিনী তাদের কর্মীদের জন্য ডিপসিক ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি কর্মীদের ডিপসিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

ইটালিতে ডেটা সিকিউরিটি অথ্যারিটি জানুয়ারির শেষের দিকে ডিপসিককে ইটালিয়ান ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণ সীমিত করতে বলেছে।

তাইওয়ানের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে সরকারি দপ্তরগুলোতে ডিপসিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে তাইওয়ান সরকার।

চায়নার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, পশ্চিমা বিশ্ব ডিপসিকের উত্থান দেখে আতঙ্কিত কারণ এটি এআই খাতে চায়নার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ডিপসিক বনাম চ্যাটজিপিটির পার্থক্য নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে।

উৎপত্তি ও মালিকানার দিক থেকে চ্যাটজিপিটি ওপেনএআই-এর তৈরি যা অ্যামেরিকাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে, ডিপসিক চায়নার একটি স্টার্টআপ।

খরচ ও কার্যক্ষমতার দিক থেকে জিপিটি-ফোর মডেল তৈরি করতে ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হলেও, ডিপসিক আর ওয়ান তৈরি হয়েছে মাত্র ছয় মিলিয়ন ডলারে। তবুও এটি জিপিটি-ফোর-এর মতোই দক্ষতা প্রদর্শন করছে।

প্রযুক্তিগত দিক থেকে চ্যাটজিপিটি ট্রান্সফরমার-ভিত্তিক বড় ভাষার মডেল জিপিটি সিরিজ ব্যবহার করে। যেখানে ডিপসিক চেইন অফ থট’ পদ্ধতি ব্যবহার করে যা ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করে উত্তর দেয়। ফলে এর উত্তরগুলো আরও বেশি নির্ভরযোগ্য ও ব্যাখ্যাসম্পন্ন হয়।

ডাটা ও সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে ফলে কিছু ক্ষেত্রে পক্ষপাত বা ভুল তথ্য থাকতে পারে। অন্যদিকে ডিপসিক চায়না সরকার-অনুমোদিত তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করে ফলে এটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয় এড়িয়ে চলে।

ডিপসিকের উত্থানে পশ্চিমা প্রযুক্তি বাজার বড় ধাক্কা খেয়েছে। ডিপসিকের দ্রুত জনপ্রিয়তার ফলে অ্যামেরিকার টেক কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। ডিপসিক অ্যাপ স্টোরের শীর্ষস্থান দখল করার পরপরই অ্যামেরিকার টেক শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হয়।

বিশেষ করে চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ার বাজারমূল্য এক দিনে ১৭ শতাংশ কমে যায় যার ফলে কোম্পানির মূল্য ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

ওপেনএআই-এর বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত, কারণ ডিপসিকের মতো কম খরচে উন্নত এআই তৈরি করা সম্ভব হলে ওপেনএআই-এর লাভজনকতা কমে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিপসিকের উত্থান দেখিয়ে দিয়েছে যে শক্তিশালী এআই তৈরি করতে বিশাল বাজেট বা অত্যাধুনিক হার্ডওয়্যার সবসময় প্রয়োজন হয় না।

ডিপসিকের প্রভাব নিয়ে চায়নার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া বলছে, ডিপসিকের উদ্ভাবন দেশটির প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়েছে । এক্ষেত্রে ডিপসিকের সাফল্য চায়নার আত্মনির্ভরতার প্রমাণ বহন করে। চায়নার উদ্ভাবনী শক্তির নতুন অধ্যায় হিসেবে ডিপসিকের উত্থানকে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই উন্নয়নে চায়নার অগ্রগতি যেমন প্রশংসনীয় তেমনি এটি নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। চায়নার এআই মডেলগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকায় সেন্সরশিপের অভিযোগ থাকছে।

ডিপসিক বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত এআই প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি। তবে এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর।

যার মধ্যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অন্যতম। এছাড়া নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা ব্যবহারকারীদের তথ্য কীভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী এআই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হতে যাচ্ছে এবং ডিপসিক এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এটি কীভাবে ভবিষ্যতে টিকে থাকবে তা সময়ই বলে দেবে।