
দাম কমছে তেলের, কী হবে উৎপাদকদের

টিবিএন ডেস্ক
প্রকাশিত: মে ৪ ২০২৫, ০:৫৪

টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মিলনস্থল ইরাকের নাহরান ওমর এলাকায় প্রাত্যহিক কাজে জেলেরা। এটি তেল উৎপাদনের জন্য বিশ্বের অন্যতম কেন্দ্রীভূত অঞ্চল। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস
- 0
ইউরেশিয়া গ্রুপ নামের নিউ ইয়র্কভিত্তিক ঝুঁকি বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি ব্রিউ বলেন, ‘তেলের দামের এ মাত্রাতিরিক্ত পতন এবং সার্বিক অস্থিরতা খুবই শক্তিশালী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি ধাক্কা খাবে এবং তা রূপান্তরিত হবে তেলের চাহিদার ঘাটতিতে।’
বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকস্মিক কমে গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। এর প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর কীভাবে পড়বে, তা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
সংকট বাড়তে পারে উৎপাদনকারী দেশগুলোর
সাধারণত তেলের দাম কমা মানে ভোক্তা দেশগুলোর লাভ হওয়া। কারণ এতে জ্বালানির বিল কমে, তবে যেসব দেশ তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এ দরপতন হতে পারে অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা।
বিশ্বজুড়ে উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা কমার কারণে অনেক বিশ্লেষক আগে থেকেই তেলের দাম কমার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
তারা বলছেন, শুল্ককেন্দ্রিক বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা এবং সার্বিক অনিশ্চিত পরিবেশ উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংকট আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এ বিষয়ে ইউরেশিয়া গ্রুপ নামের নিউ ইয়র্কভিত্তিক ঝুঁকি বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি ব্রিউ বলেন, ‘তেলের দামের এ মাত্রাতিরিক্ত পতন এবং সার্বিক অস্থিরতা খুবই শক্তিশালী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি ধাক্কা খাবে এবং তা রূপান্তরিত হবে তেলের চাহিদার ঘাটতিতে।’
কী হবে ধনী উৎপাদকদের
চলতি বছরের শুরুতে তেলের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত অশোধিত জ্বালানি তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল প্রায় ৭৩ ডলার। এটি বেশির ভাগ উৎপাদনকারী দেশের বাজেট স্বাভাবিক রাখার জন্য যথেষ্ট, তবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কিছু দেশ উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলার বা তার চেয়ে বেশি দামের ওপর নির্ভর করে।
দেশ দুটি তাদের অর্থনীতিকে তেলনির্ভরতা থেকে বের করে আনতে শত শত বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
সৌদি আরব তার ‘ভিশন-২০৩০’ উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বার্ষিক বাজেটের বাইরে থেকে অর্থায়ন করে, তবে দেশটি ভবিষ্যৎমুখী নগর প্রকল্প নিয়মের জন্য তেল বিক্রির অর্থের ওপর নির্ভর করে।
বিশ্লেষকদের মতে, তেলের দাম পড়ে গেলে এসব দেশ হয় তাদের বিশাল রিজার্ভ ফান্ড থেকে অর্থ তোলার পথ বেছে নেবে অথবা ঋণ নিতে হবে তাদের। সৌদি আরব, আমিরাত এবং কুয়েতের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ গ্রহণ সহজ। তাই সাধারণ নাগরিকদের এর প্রভাব তেমন টের পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ইরান ও ইরাকের চিত্র আলাদা
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেলের ক্রেতা একের পর এক কমেছে। চীন তাদের প্রধান ক্রেতা হলেও দেশটির অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে যাওয়ায় তেলের চাহিদা কমে গেছে।
অন্যদিকে কিছু স্বতন্ত্র রিফাইনারি রয়েছে যেগুলো অ্যামেরিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে আছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এমন দুটি রিফাইনারির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে অ্যামেরিকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রেতা টানতে ইরানকে হয়তো অনেক কম দামে তেল বিক্রি করতে হবে। আর কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি হলে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে পারে, তবে চলতি বছর তা সম্ভব নয়।
জ্বালানিতে অভ্যন্তরীণ ভর্তুকি কমিয়ে ব্যয় সংকোচনের ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে ইরান, তবে ২০১৯ সালে ভর্তুকি কমানোর পর সরকারবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়, যা বলপ্রয়োগ করে দমানো হয়।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান কেপলারের বিশ্লেষক হোমায়ুন ফালাকশাহি বলেন, ‘জ্বালানির দাম খুবই কম রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা (ইরান) জানে, সেটা না করলে তাদের সামনে বিদ্রোহ, দাঙ্গা বা বিক্ষোভের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।’
প্রতিবেশী দেশ ইরাকের সরকারি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে তেল বিক্রি থেকে। দাম পড়ে গেলে সরকারকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চাকরিজীবীদের বেতন না দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। এতে অসন্তোষ ছড়াতে পারে দেশটিতে। নিষেধাজ্ঞা না থাকায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঋণ নিতে পারবে দেশটি। যদিও তা ব্যয়বহুল হবে।
লিবিয়া, নাইজেরিয়া ও ভেনেযুয়েলার সম্ভাব্য ঝুঁকি
লিবিয়ায় আলাদা দুটি সরকার রয়েছে। একটি বিদেশ থেকে আসা তেল বিক্রির অর্থ গ্রহণকারী ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ করে। অপরটির হাতে তেলক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ। তেলের দাম কমে গেলে এ দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেনার বাড়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তেল বিক্রির আয় কমার সঙ্গে নাইজেরিয়ার অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়ার সম্পর্ক ব্যাপক। দেশটি তেল বিক্রি করে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ভর্তুকির খরচ মেটায়।
নাইজেরিয়ায় নতুন একটি বেসরকারি রিফাইনারি চালু হওয়ার পথে, যা দেশটির তেল সরবরাহ সমস্যা কমাতে পারে।
ইরানের পর তেলের দাম কমার ফলে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকা আরেকটি উৎপাদনকারী দেশ হলো ভেনেযুয়েলা। ২০১৪-১৫ সালে তেলের দাম কমার ফলে দেশটির অর্থনীতিতে ধস নেমেছিল।
সরকারের খরচ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এতটাই তেলের ওপর নির্ভরশীল ছিল যে, দাম পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। সহিংস কায়দায় সে বিক্ষোভ দমন করে সরকার।
এবার রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় কিছুটা প্রস্তুত ভেনেযুয়েলা। উৎপাদন ও রিফাইনারি বাড়ায় দেশটিতে জ্বালানি ঘাটতির সম্ভাবনা কম।
রাশিয়ার পরিস্থিতি কী
রাশিয়ার ফেডারেল বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আসে ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারে জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে। তারা প্রতি ব্যারেল তেলে প্রায় ১০ ডলার ছাড় দিয়ে বিক্রি করে, যাতে দাম দাঁড়ায় প্রায় ৬০ ডলার। এ মূল্যসীমা ২০২২ সালে ইউক্রেইন আক্রমণের পর আরোপ করা হয়েছিল।
চীন ও ভারতে তেল রপ্তানি বাড়ায় রাশিয়ার সাধারণ জনগণ এখনও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি, কিন্তু যুদ্ধ চালাতে ও অভ্যন্তরীণ ব্যয় সামলাতে রিজার্ভ ফান্ডে হাত দিতে হয়েছে দেশটির।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তেলের দাম আরও কমলে রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়বে।
তাদের ভাষ্য, রাশিয়ার হাতে সম্ভবত এখনও যথেষ্ট অর্থের মজুত রয়েছে, কিন্তু স্বল্পমেয়াদে ব্যথা অনুভব করতে হতে পারে দেশটির।