পাঁচ বছরে প্রথমবারের মতো ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন শি জিনপিং

টিবিএন ডেস্ক

মে ৫ ২০২৪, ১৫:৪১

চায়নার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ছবি: সংগৃহীত

চায়নার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

শি জিনপিং সবশেষ ২০১৯ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে ইটালি এসেছিলেন। তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ইটালির যোগদানের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিতের ওই সফরে বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন বিভিন্ন রোমান ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শন ও অপেরার আসরে অংশগ্রহণ করে। পাঁচ বছর পর চায়নার প্রেসিডেন্ট ইউরোপে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি আবহ বিরাজমান থাকা অবস্থায় এই মহাদেশটিতে সফরে যাচ্ছেন।

শি রোববার ফ্রান্স থেকে তার ছয় দিনব্যাপী ইউরোপ সফর শুরু করবেন।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চায়নার উইন্ড টারবাইন ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের ওপর বাণিজ্য তদন্ত শুরু করেছে। সংস্থাটি ভর্তুকি সংক্রান্ত তদন্তের অংশ হিসেবে চাইনিজ নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক নাকটেকের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে।

জার্মানি ও ইউকে সম্প্রতি গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে চায়নার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছয়জন ব্যক্তিকে আটক করেছে।

গত মার্চ মাসে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর একমাত্র জি-সেভেন জোটভুক্ত দেশ হিসেবে শি এর এই প্রকল্পটি থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে ইটালি।

বার্লিন ভিত্তিক জার্মান মার্শাল ফান্ড অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেইটস এর সিনিয়র ফেলো নোয়াহ বারকিন বলেন, ‘চায়নাকে অনেক ইউরোপিয়ান দেশে বহুমাত্রিক হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত ক্ষেত্রে চায়না সম্পর্কে উদ্বেগ মোকাবিলায় কতটা দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত তা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ রয়েছে।’

এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স, সার্বিয়া ও হাঙ্গেরিতে শি এর সফরকে তার সমালোচকদের প্রতি একটি জবাব হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইউরোপের কিছু অংশে চায়নার প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও যে বেশ কয়েকটি দেশ চায়নার প্রতি উদারতার নীতি গ্রহণ করেছে- শি এর ইউরোপ সফর এটাই প্রমাণ করে।

বেইজিং কথিত বাণিজ্য যুদ্ধ মোকাবিলায় ইউরোপের প্রচেষ্টাকে বাধা দেয়ার পথ বেছে নেবে। আসন্ন অ্যামেরিকান নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ইউরোপ যেন অ্যামেরিকার আরও ঘনিষ্ঠ না হয়ে পড়ে, এই বিষয়টিও তারা নিশ্চিত করতে চায়।

শি চমক জাগানোর মতো কোন ছাড় না দিলে চায়নার কট্টর সমালোচকদের নেয়া যেকোন উদ্যোগের সফলতার মুখ দেখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, শি এর এই সফরটিকে সাধারণ একটি সফর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। তাদের ধারণা এর সফরেই ইউরোপের দেশ হয়েও কারা চায়নার পক্ষ নেবে আর কারা নেবে না তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

চায়নার নেতা শি জিনপিং এর সোমবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ছাড়াও ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে।

চায়নার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা ইউরোপের জন্য ক্ষতিকর হবে- শি বৈঠকে তার এই বক্তব্য তুলে ধরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। চায়নার কথিত অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা ও বাণিজ্য ভর্তুকি সম্পর্কে ইউরোপের উদ্বেগ কমাতে জোর দেয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট কমাতে চায়নার ইলেক্ট্রিক ভেহিকল (ইভি) গুলোও যে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাত করবেন শি।

তবে কোন ধরণের চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা বা বাণিজ্য ও পারস্পরিক বাজারে অ্যাক্সেস দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছাড়া চায়না সম্পর্কে ভন ডার লিয়েনের মনোভাব পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।

পর্যবক্ষকরা বলেছেন, তিনি জুনে ইইউ এর পার্লামেন্টারি নির্বাচনের আগেই চায়নার সঙ্গে বাণিজ্য বৈষম্য মোকাবিলার উপায় বের করতে চান।

ম্যাক্রোঁর সঙ্গে বৈঠকে চায়নার সঙ্গে ফ্রান্সের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ও বিদ্যমান সম্পর্কের উন্নয়নের ওপর জোর দিতে পারেন শি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাসভবনের কয়েকটি সূত্র বলছে, কেবল প্যারিসেই নয়, দুই নেতা পাইরেনিস মাউন্টেইনসেও একান্ত আলোচনায় বসতে পারেন।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর এর পলিটিকাল সায়েন্স এর অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর চং জা লান বলেন, ‘ফ্রান্স ইইউতে মোটামুটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র হিসেবে ও অ্যামেরিকার সঙ্গে আগের চেয়ে কিছুটা বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে ইচ্ছুক।’

তিনি আরও বলেন, ‘অ্যামেরিকা থেকে ইউরোপের দূরত্ব আরও বাড়ানো যায় কিনা তা যাচাই করতে ম্যাক্রোঁর সঙ্গে কাজ করতে চাইতে পারেন শি।’

ইউরোপ-চায়না সম্পর্কের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে এই সপ্তাহের শুরুতে বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে থাকতে পারে ইউক্রেইন যুদ্ধের বিষয়টি। সেখানে শি চায়নার নিরপেক্ষ ও শান্তিপ্রিয় অবস্থান প্রমাণ করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বেইজিং এর রেনমিন ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর ওয়াং ইয়েই বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট শি রাশিয়ার সঙ্গে চায়নার সম্পর্ক ব্যখ্যা করার পাশাপাশি ম্যাক্রোঁকে এটাও বোঝাতে চাইবেন যে, রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে দূরত্ব কমানোর জন্য চায়না মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে।’

এদিকে রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চলতি মাসে চায়না সফরের পরিকল্পনা করছেন।

তবে ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে চায়না আদতে রাশিয়ারই পক্ষ নিচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অ্যামেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন।

বারকিনের মতে, চায়না যদি রাশিয়াকে এই পণ্যগুলো সরবরাহ করা চালিয়ে যায় তবে শি-কে ইউরোপের সঙ্গে চায়নার সম্পর্কের সম্ভাব্য অবনতির বিষয়ে সত্ক করতে পারেন ম্যাক্রোঁ এবং ভন ডার লিয়েন।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্রান্স সফরের মতো শি এর সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি সফর এতটা গুরুত্ব বহন নাও করতে পারে।

বারকিন বলেন, ‘বেলগ্রেড ও বুদাপেস্টে অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের মতো সমালোচনার মুখোমুখি হবেন না শি। তাদের নেতারা চায়নার বিনিয়োগতে স্বাগত জানিয়েছে এবং চায়নার সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে তাদের কোন সমস্যা নেই।’

বেলগ্রেডে চাইনিজ অ্যাম্বাসিতে ন্যাটো জোটের বোমা হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার ২৫ তম বর্ষপূর্তিতে শি সেখানে সফরে যাবেন।

শি তার এই সফরে ইউরোপের জন্য চায়নার বার্তা হিসেবে বেলগ্রেড ও বুদাপেস্ট উভয় জায়গাতেই চাইনিজ বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন।

ইইউ জোট বহির্ভূত দেশ সার্বিয়াকে চলতি সপ্তাহে বেইজিং তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিচ এর অধীনে দেশটি নিয়মিতই চায়নার সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে।

হাঙ্গেরি সফরে শি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান এর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। চায়নার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেয়া যেকোন পদক্ষেপে বাধা দেয়া বা সমালোচনা করায় ওরবান এই পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন